সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০২ পূর্বাহ্ন
মোঃ আনোয়ার হোসেন >> বরিশাল ছাত্র-জনতার গণঅভুত্থ্যানে গত বছরের আগস্টে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন আসলেও বরিশালের সরকারি দপ্তরগুলোতে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসরদের আধিপত্য কমেনি। মুজিববাদে বিশ্বাসী কর্মকর্তারা দপ্তরসমূহে বহাল তবিয়তে থাকাসহ আওয়ামী লীগের চেতনা ধরে রাখতে বহুমুখী কূটকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। এনিয়ে কখনও কখনও তুমুল বিতর্ক পরবর্তী আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক স্বপদ থেকে সরিয়ে নেওয়ার একাধিক উদাহরণও রয়েছে। কিন্তু এর পরেও স্বৈরাচারের দোসরদের লাগাম যেনো টানা সম্ভবপর হচ্ছে না, যার জ¦লন্ত উদাহরণ বরিশালের লাকুটিয়া বীজ উৎপাদন ও খামারের সিনিয়র সহকারি পরিচালক পপি বৈরাগী।

গত ১৫ জুলাই এই কর্মকর্তা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসংবলিত প্যাডে একটি চিঠি ইস্যু করলে এনিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে সেই চিঠি তিনি পরিবর্তন করলেও এই নারী কর্মকর্তাকে ঘিরে বিতর্ক বেড়েই চলছে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলা এবং সংবাদ বন্ধে বিভিন্ন মহল থেকে তার একাধিক সুপারিশ বিতর্ক আরও জোরালো করে তুলেছে।
সপ্তাহখানের আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক মোহাম্মদ সাখায়াত হোসাইনকে প্রক্টর করা হলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। বিশেষ করে এই শিক্ষককে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যায়িত করে জুলাইযোদ্ধারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। এতে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে সেই শিক্ষক প্রক্টর পদ থেকে গত দুদিন আগে সরিয়ে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই ঘটনায় ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ৫ বছর আগের মুজিববর্ষের প্যাডে চিঠি ইস্যু করে যেনো তপ্ত আগুনে ঘি ঢেলেছেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের কর্মকর্তা পপি বৈরাগী।
সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ জুলাই লাকুটিয়া বীজ উৎপাদন খামার কার্যালয় থেকে ১২.০৬.০৬৫১.২৭২.৯৯.০০১.২৪.১৩ নং স্বারকে একটি চিঠিটি ইস্যু করা হয়। এবং কৃষিবিদ পপি বৈরাগী স্বাক্ষরিত এই চিঠিটি বরিশাল শহরের সিঅ্যান্ডবি রোডের বীজ প্রত্যায়ন অফিসার বরাবর মেইলে পাঠানোর পাশাপাশি অনুলিপি অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (খামার), বিএডিসি, কৃষিভবন, ঢাকায়ও প্রেরণ দেখানো হয়। চিঠিটিতে ‘২০২৪-২৫ উৎপাদনবর্ষে উৎপাদিত বোরো ধানবীজ ফসলের তথ্য প্রেরণ প্রসঙ্গ’ মূল বিষয়বস্তু থাকলেও বাধ সাধে মুজিববর্ষের প্যাড ব্যবহার এবং এতে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নিয়ে।
সূত্র জানিয়েছে, সরকারি বেতনভুক্ত কর্মকর্তা পপি বৈরাগীর মুজিবপ্রীতি প্রকাশ পাওয়া এবং এনিয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হলে তিনি তড়িঘড়ি ঘরে একই স্বারকে অনুরূপ একটি চিঠি ইস্যু করে। তবে সেই চিঠিতে আর শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখা যাচ্ছে না। ফলে তিনি যে চিঠিটি ইস্যু করেননি তা অস্বীকার করার সুযোগও থাকছে না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চিঠিটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হলে এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া এবং নেপথ্য হেতু কী জানতে বরিশালের সাংবাদিকেরা দৌড়ঝাপ শুরু করেন। বিতর্কিত চিঠি ইস্যুর দুদিন পরে অর্থাৎ ১৭ জুলাই সংবাদকর্মীরা লাকুটিয়া অফিসে গিয়ে পপি বৈরাগীর সাক্ষাৎ পেলেও তিনি মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যান। এরপরে সাংবাদিকেরা ২/৩ ঘণ্টা বসে থেকেও তার আর সাক্ষাৎ লাভ করতে পারেননি। এমনকি মুঠোফোনেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ২০ এবং ২৪ জুলাই দুদিন অফিসে গিয়েও তার দেখা মেলেনি। তবে তিনি সাংবাদিকদের ম্যানেজ করতে বিভিন্ন মহল থেকে তদ্বির রাখেন, এমনকি আর্থিক সমঝোতার প্রস্তাবও দেন।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বরিশাল অফিসের বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পরে সরকারি অধিকাংশ দপ্তরগুলোতে কর্মকর্তারা রদবদল হলেও এই অফিসটিতে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্যণীয় নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ এক বছর হতে চললেও দপ্তরটিতে আওয়ামী লীগের দোসরদের আধিপত্য মোটেও কমেনি। বর্তমানে যারা শীর্ষ পদে রয়েছেন তাদের অধিকাংশই মুজিব চেতনায় বিশ্বাসী এবং তারা পূর্বের ন্যায় স্বেচ্ছাচারিতায় চালিয়ে যাচ্ছেন।
লাকুটিয়া বীজ বীজ উৎপাদন খামার কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, মুজিববর্ষের প্যাডে কর্মকর্তা পপি বৈরাগীর ইস্যু করা চিটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে পারে, এনিয়ে ১৫ জুলাই-ই দপ্তরটিতে আলোচনা হয়। এবং এই চিটি পাঠানো নিয়ে কার্যালয়টির কজন কর্মচারী আপত্তিও তোলেন। কিন্তু পপি বৈরাগী উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ায় তাদের সেই আপত্তি আর ধোপে টেকেনি।
তবে আত্মপক্ষ সমর্থনে কর্মকর্তা পপি বৈরাগী বলছেন, এই বিতর্কিত চিঠি ইস্যু করার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। এবং কি ভাবে তার স্বাক্ষরিত চিঠি অফিস থেকে মেইল গেছে সে সম্পর্কেও তিনি অবগত নন। অথচ এই কর্মকর্তাই গত ১৭ জুলাই সংবাদকর্মীদের সাক্ষাতে দাবি করেছিলেন চিঠিটি ভুলে মুজিববর্ষের প্যাডে ছাপা হয় এবং তা মেইল করে বীজ প্রত্যায়ন অফিসার বরাবর পাঠানো হয়েছিল। কর্মকর্তা দুই ধরনের বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি চাকরি রক্ষার্থে এখন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, শনিবার মুঠোফোনে বিষয়টি নিয়ে তার সাথে আলাপচারিতার পরে তিনি অতীতের ন্যায় ফের সংবাদ বন্ধে কৌশলী পদক্ষেপ নেন এবং তিনি এবার রাজনৈতিককে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। বরিশাল মহানগর ছাত্রদলের পদধারী এক নেতা প্রতিবেদককে শনিবার রাতে ফোন বিষয়টি চেপে যাওয়ার অনুরোধ রাখেন। জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে ওই ছাত্রদল নেতা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের বেশকিছু কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন।
বিতর্কিত মুজিববর্ষের প্যাডে চিঠি ইস্যু নিয়ে জানতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার রফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া মেলেনি।
তবে এখনও সরকারি দপ্তরসমূহে স্বেরাচারের দোসর বহাল থাকা এবং মুজিবের চেতনা জাগ্রত করা রাখায় অপপ্রয়াস নিয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য আবু সাঈদ মুসা। তরুণ এই রাজনৈতিক অভিযোগ করেন, এখনও শেখ মুজিবের ছবিসংবলিত প্যাডে সরকারি দপ্তরের চিঠি ইস্যু করা জাতির সাথে প্রতারণার সামিল এবং এই ধরনের অপকর্ম করার জন্য জুলাই আন্দোলন হয়নি। সুতরাং এই বিতর্কিত কর্মকান্ডে যিনি বা যারা জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।