শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৩ অপরাহ্ন
অনুসন্ধান২৪>>বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলো, এটা স্মরণকালের মধ্যে দেশে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। ভূপৃষ্ঠে এত তীব্রতা এর আগে আমরা কখনো অনুভব করিনি। ঢাকার নগরবাসী সাংঘাতিক আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে খুবই কাছে, ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব কোণে নরসিংদীর মাধবদী উপজেলা। এখানে আমাদের জিওলজিক্যাল সেটআপ বা টেকটনিক গঠন (ভূতাত্ত্বিক গঠন বা বিন্যাস), সেখানে দুটো প্লেটের সংযোগস্থলে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি, গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। এই সংযোগস্থলটা সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর এলাকা হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরের আন্দামানে চলে গেছে। সংযোগস্থলের পূর্বেরটি হচ্ছে বার্মা প্লেট এবং পশ্চিমেরটি ইন্ডিয়ান প্লেট।
এই দুটি প্লেটের সংযোগস্থলকে গবেষকেরা বলছেন সাবডাকশন জোন। এর মানে, একটি প্লেটের নিচে যখন আরেকটি প্লেট তলিয়ে যায়। আমাদের এই সাবডাকশন জোন সিলেট থেকে কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর নিচে ইন্ডিয়ান প্লেটটা তলিয়ে যাচ্ছে। নরসিংদীতে প্লেটের যে সংযোগস্থল, সেখানেই ভূমিকম্প হয়েছে।
ভূমিকম্পের তীব্রতাকে বলা হয় মডিফাইড মারকেলি ইনটেনসিটি (এমএমআই); এলাকাভেদে ৫ থেকে ৬ ছিল। এটা নির্ভর করে ভূমিকম্পের তরঙ্গের ওপর। খুব ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ তরঙ্গ। এর পাশাপাশি মাটি নরম হলে এক রকম হবে; শক্ত হলে আরেক রকম হবে। আমাদের দেশের মাটির গঠন স্বাভাবিকভাবেই নরম। সেখানে এই ভূপৃষ্ঠের আন্দোলনটা বেশি হবে। গতকাল যেটা দেখা গেছে, সুউচ্চ ভবনগুলো দুলছে। বড় লম্বা গাছ যে রকম বাতাসে দোলে, ভবনগুলো একই রকম দুলছিল বলে আমাকে একজন ফোন করে জানিয়েছেন।
প্লেটের সংযোগস্থলের শক্তি দীর্ঘ ৮০০ থেকে ১ হাজার বছর ধরে সঞ্চয় করা। আজ হোক কাল হোক, এই শক্তি বের হবেই; ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করার শক্তি এখানে জমা হয়ে আছে। যার মধ্যে বৃহৎ প্লেট বাউন্ডারির একটি ক্ষুদ্র শক্তি আনলক হলো মানে খুলে গেল। এই যে খুলে গেল, আরেকটা বিপদ আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। সামনে এই শক্তিগুলো বের হওয়াটা সহজ হবে।
আমরা সামনে একটা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আছি। আমাদের যেখানেই ভূমিকম্প হোক, ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে ঢাকায়, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে। ঢাকা হচ্ছে সবচেয়ে জনবহুল, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত। এখানকার ৯৫ শতাংশ অবকাঠামো অপরিকল্পিত। এমনকি সরকারি ভবনও ‘বিল্ডিং কোড’ (ইমারত নির্মাণ বিধিমালা) অনুসরণ করে না। এখানে ব্রিটিশ সময়কাল থেকে শুরু করে পাকিস্তান সময়ের ভবনও আছে। এখন ‘ফ্যান্সি’ ভবন করা হচ্ছে; কিন্তু ভূমিকম্প সহনশীল করা হচ্ছে না। খরচের দোহাই দিয়ে এটাকে উপেক্ষা করা হয়।
আমাদের যে বিল্ডিং কোড আছে, সেটিও অপ্রতুল। এখানে ভূতত্ত্ববিদদের মতামত নেওয়া হয়নি। প্রকৌশলীরা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবে হয়েছে। এরপরও এই বিষয়গুলো আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। আমি মনে করি, এখন যেভাবে আমাদের নগরায়ণ হয়েছে, এটাকে আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরেও পরিবর্তন করা যাবে না।
এখন আমাদের স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা করা দরকার দ্রুত। নগরবাসীকে ব্যক্তি পর্যায়ে, পারিবারিক পর্যায়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ভূমিকম্পকালীন কী থাকা দরকার এবং ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে কার কী দায়িত্ব, সেগুলো পালন করতে হবে। ভূমিকম্পের আগে, ভূমিকম্পের সময় এবং ভূমিকম্পের উৎস—এই কলাকৌশলগুলো নিয়ে যদি আমরা ‘ন্যাচারাল হেজার্ড গেম’ তৈরি করি এবং সেটা যদি উন্মুক্ত একটা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তরুণদের কাজে লাগাতে পারি, তাহলে একটা ইতিবাচক দিক আমরা তৈরি করতে পারব। এর মধ্যে ভূমিকম্পের সময় কোন কোন জায়গা নিরাপদ, রাস্তায় কোন কোন জায়গাটা নিরাপদ, ঘরের মধ্যে থাকলে কোন জায়গাটা নিরাপদ, অফিস ও অন্য বিষয়গুলো থাকবে।
এরপর আমাদের পরবর্তী কাজ হলো ভূমিকম্প নিয়ে নিয়মিত মহড়া। যতক্ষণ আমরা মহড়া না করব, এই অনুশীলন না করব, ততক্ষণ আমাদের মানসিক মনোবল বৃদ্ধি পাবে না।
এটি অনুসরণ করলে আমরা জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে আনতে সক্ষম হব। আর সরকারের ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজ নিয়ে যে পরিকল্পনা, সেটি আমি সব সময় বলে আসছি, আমাদের এটার খুব একটা প্রয়োজন নেই। যত বাজেট, তত বাণিজ্য। তার ১ শতাংশের কমও যদি মহড়ায় ব্যয় করা যায়, তাহলে ভূমিকম্পের জন্য কার্যকর একটি পদ্ধতিতে জনগণকে সচেতন করা সম্ভব হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই।